হাতির নজর এখন কৃষকের ধানের গোলায়
থামছে না হাতি মানুষের যুদ্ধ; বাড়ছে মৃত্যু
অসহায় হয়ে পড়েছে শ্রীবরদীর সীমান্তবাসী
বিদ্যুতায়নের দাবী
ভারতীয় সীমান্তবর্তী শেরপুর জেলার শ্রীবরদী উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো এখন বন্য হাতির অভয়াশ্রমে পরিনত হয়েছে। গত এক মাসে বন্যহাতির আক্রমনে এ এলাকায় ২ কৃষক নিহত ও ১ কৃষক আহত হয়েছে। মাঠের পাকা ধান খেয়ে সাবার করে এখন হাতি হামলে পড়ছে কৃষকদের ধানের গোলায়। থামছে না বন্যহাতি আর মানুষের যুদ্ধ। প্রতিনিয়তই বন্যহাতির আক্রমণে দীর্ঘ হচ্ছে হতাহতের তালিকা। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে হাজার হাজার একর জমির ধান ও সবজি। তছনছ করছে বন বাগানের বিপুল পরিমাণ গাছ। লন্ডভন্ড হচ্ছে ঘড়বাড়ি। বনহাতির দল শ্রীবরদীর সীমান্তবর্তী কয়েকটি পয়েন্টকে স্থায়ী আবাসস্থল হিসাবে ব্যবহার করায় সীমান্তবর্তী ২৫ টি গ্রামের মানুষের জীবন এখন হুমকির মুখে।
জানা গেছে, গারো পাহাড়ের পাদদেশে ভারতের মেঘালয় প্রদেশের সীমান্তঘেষে অবস্থিত জনপদ শ্রীবরদীর বালিজুরি, রাঙ্গাজান, খাড়ামোড়া, হালুয়াহাটি, মালাকোচা, কর্ণঝোড়া, বাবেলাকোনা, হারিয়াকুনা, ঝোলগাও, পাঁচমেঘাদল, গারোপাড়া,কোচপাড়া সহ ১৩টি ও পাশ্ববর্তী বকসীগঞ্জের বালুঝুরি, টিলাপাড়া, লাউচাপড়া, ডুমুরতলা, দিঘলকোনা, হাতিবেড়কোনা, শোকনাথপাড়া, সাতানিপাড়া, কনেকান্দা, চন্দ্রপাড়া সহ ১২টি গ্রামে বাঙালি, হিন্দু গারো কোচ হাজং মিলে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বাস। উলে¬খিত এলাকায় বাংলাদেশ ও ভারতের ভূখন্ডে রয়েছে বিশাল বনভূমি।বাংলাদেশের বনাঞ্চল অপেক্ষাকৃত সমতল। একসময় বন্যহাতির দল মাঝেমধ্যে বাংলাদেশের ভূখন্ডে আসলেও বর্তমানে কয়েকশত হাতির দল বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে শ্রীবরদী সীমান্তে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। বিগত ১১ বছর ধরে এসব বুনো হাতি তান্ডবলীলা চালিয়ে সীমান্তবর্তী উলে¬খিত পাহাড়ি গ্রামগুলোতে কয়েকশত ঘড়বাড়ি গুড়িয়ে দিয়েছে। হাজার হাজার একর জমির ধান, শাকসবজি, ফসল খেয়ে এবং বাগানের গাছপালা দুমড়ে-মুচড়ে সাবাড় করে চলছে। এবার আমন মৌসুমে হাতির দল অন্যান্যবারের চেয়ে উগ্র মূর্তি নিয়ে হামলে পড়ছে লোকলয়ে। গতমাসে বন্যহাতির আক্রমণে রানীশিমূল ইউনিয়নের হালুয়াহাটি গ্রামে আমিনুল ইসলাম ও মিষ্টার নামে ২ কৃষক নিহত ও অপর আরেক কৃষক আহত হয়েছে। এছাড়া বুনো হাতির আক্রমনে বালিজুরি গ্রামের হামির উদ্দিন, বাবুল মিয়া, খ্রিস্টান পাড়ার স্টারসন, ঝুলগাও গ্রামের মজিবর, সিরাজ, হাতিবর গ্রামের বৃন্দাবন দাস, মাখনের চর গ্রামের হাসান, হাবিব, বাঘার চর গ্রামের আবু তালেব সহ অর্ধশতাধিক মানুষের প্রান হানি ঘটেছে। কয়েকশ মানুষ আহত হয়েছে। এদের মধ্যে কমপক্ষে ১৫ জন পঙ্গুত্ব বরণ করে দূবির্ষহ জীবন যাপন করছে। গৃহহীন হয়ে পড়েছে অনেক পরিবার। ঝুলগাও গ্রামের আঃ রাজ্জাক, শাহজাহান, ফিলিপ মারাক জানান, আগে আগুন দেখে হাতি ভয়ে চলে যেত। কিন্তু এবার আগুন ঢাকডোলে কাজ হচ্ছে না। বালিজুরি গ্রামের মন্টু, মানিক, মঞ্জু, ফটিক, রসিদ খাড়ামোড়াগ্রামের বারেক, তোতা, রফিকুল, আমিনুল, তৈয়ব আলী, জহুরুল সহ ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জানান, এলাকায় প্রথম হাতি আসে ২০০০ সালের দিকে। সে সময় মাঝে মধ্যে ভারত থেকে ছোট ছোট হাতির দল ধান ক্ষেত নষ্ট করতো। কিন্তু ভারত সরকার তাদের ভূখন্ডে সীমান্তঘেষে বিদ্যুতায়ন করলে হাতি বাংলাদেশে স্থায়ী আবাসস্থল গড়ে তুলে। খাড়ামোড়া, বালুবাড়ি ও নয়াবাড়িতে বুনোহাতিরদল নিজেদের স্থায়ী আবাসস্থল হিসাবে ব্যবহার করছে। গ্রামবাসী আরও জানান, এতদিন হাতির দল ক্ষেতে আক্রমণ করে পাকা ধান সাবাড় করেছে। এখন ক্ষেতে ধান না থাকায় আক্রমণ করছে কৃষকদের ধানের গোলায়। এতে প্রাণহানির সংখ্যা আরও বাড়বে বলে তারা ধারনা করছে। এলাকাবাসীর ধারনা ভারতে যেমন বিদ্যূত দেয়ার ফলে হাতিদল এদিকে চলে এসেছে তেমনি এ অঞ্চলে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করলে হাতির আক্রমন থেকে তারা রক্ষা পাবে। স্থানীয় ইউপি সদস্য ছোহরাব আলী বলেন, আগে হাতি ফলপাকা ও পাকা ধানের সময় অত্যাচার করতো। কিন্তু এখন সারাবছরই অবস্থান করে জানমাল ও ফসলের ক্ষতি করছে। তিনি জানান, সীমান্তবর্তী বালিজুড়ি বাজার থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে সাবেক এমপির এমএ বারী সাহেবের বাড়ি পর্যন্ত বিদ্যুতের ব্যবস্থা রয়েছে। সেখান থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার দাবি জানান।
সরজমিন ঘুরে জানা গেছে, সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকার মানুষ পাহাড় থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করে এবং এবং পাহাড়ের পাদদেশে চাষাবাদ করে কোনও রকমে জীবিকা নির্বাহ করে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য, বঞ্চনা তাদের নিত্যসঙ্গি। এর ওপর বন্যহাতির আক্রমন তাদের দিশেহারা করে দিয়েছে। হাতি আতংকে অনেক জমি এমনিতেই পতিত থাকছে। জীবনের ঝুকি নিয়ে আবাদ করলেও সে ফসল তারা ঘরে তুলতে পারছে না। বরং এখন হাতির দল হামলে পড়ছে বসতবাড়িতে। আক্রমণ করে খেয়ে যাচ্ছে কৃষকের গোলার ধান। ফলে পাহাড়ি জনপদের মানুষ হাতির সঙ্গে নিয়মিত যুদ্ধ করে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। বন্যহাতির সমস্যা থেকে পরিত্রানে হাতিউপদ্রব গ্রামগুলোতে বিদ্যুতায়নের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে সীমান্তবাসী।
মোঃ কামরুজ্জামান আবু

0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন