রোম্মান আরা পারভীন \
“রামদাস মুচির ভক্তিতে,/ গঙ্গা এল চামকেটোতে।/ সে রূপ সাধলো কত মহতে/ লালন কূলে কূলে বায়!/ অনুরাগ নইলে কি সাধন হয়.../
সে তো শুধু মুখের কথা নয়।” লালন জাত-পাত মানতেন না বলে রামদাস মুচি তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ
ব্যক্তি ছিলেন। তাই লালন পদাবলীতে লালন রামদাস মূচিকে নিয়ে লিখে গেছেন। কিন্তু আমাদের সমাজে আমরা মূচি বা রবিদাস
সম্প্রদায়কে এই আধুনিক যুগেও একটু সহানুভূতি দেখাতে পারি না। কিন্তু পশু মারা গেলে, নর্দমা- আবর্জনা পরিস্কার করতে এরাই হয়ে পড়ে আমাদের একমাত্র
অবলম্বন। অথচ তারাও যে আমাদের মতো মানুষ, তাদেরও আমাদের
মতো রয়েছে স্বাধ, স্বপ্ন। অন্যান্য মানুষের মতো রয়েছে বেঁচে থাকার,
রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা পাওয়ার সম-অধিকার।রবিদাসরা কি তাদের
প্রাপ্য অধিকার পাচ্ছে? বঞ্চনা, কর্মহীনতা আর জাত প্রথার বলি, রবিদাসদের এখন বড়ই দূর্দিন।
শ্রীবরদী উপজেলার রানীশিমুল ইউনিয়নের হিন্দুপাড়া, টেংগরপাড়া ও বিলভরট গ্রামের হরিজন পল্লীতে রবিদাস সম্প্রদায়ের
বাস। টেংগরপাড়া সরকারি জমির
উপর স্যাতস্যাতে গিজগিজ পরিবেশে হরিজন পল্লীতে ঢুকতেই গা শিউরে উঠে।
হরিজন পল্লীতে বসবাসকারী রবিদাস (মূচি) সম্প্রদায়ের মানুষেরা
নিজেদেরকে ‘রবিদাস’ বলে পরিচয় দিলেও এলাকার মানুষজন অনেকেই জানে যে এসব মানুষের আরেকটা ভাল নাম রয়েছে
যে নামে তারা পরিচিত হতে উষ্ণ অনুভব করে, যে নামে দাসত্ব
কিংবা অবহেলার নামধারী জীবন যাপন করতে চায়না। কিন্তু জাত প্রথার এ সমাজ বুঝে না,
তারাও মানুষ।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, সতেরো শতকের শুরুর দিকে ভারতবর্ষ থেকে কিছু মানুষকে এই অঞ্চলে নিয়ে আসা হয় সুইপার,
ঝাড়–দার, পরিস্কার- পরিচ্ছন্নতার
কাজ, চামড়ার কাজ, শবদাহ করা ইত্যাদি
করার জন্য। আর সেই থেকে আজ পর্যন্ত এটা তাদের বংশগত এবং ঐতিহ্যগত পেশা হয়ে যায়। যুগের পর যুগ,
সভ্য সমাজ, রাষ্ট্র, ব্যক্তি তাদের জন্য এমন সব সিস্টেম তৈরী করে রাখে, যা থেকে আজ পর্যন্ত তাদের পরিত্রাণ হয়নি।
নানা সমস্যার বেড়াজালে বন্দি হয়ে আজ অস্তিত্ব সংকটে শ্রীবরদীর
তিন গ্রামের ‘রবিদাস’রা। অনেকেই এখন পৈতৃক এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায়
যুক্ত হচ্ছেন।
হিন্দুপাড়ার শ্রীমতি স্বরসতি বলেন “আগে আমাগোর পুরুষরা চামড়ার কারবার করতো। কিন্তু এ পেশায় এখন পেট চলে না।” একই ভাবে শ্রীমতি তেতারী, বাতাসী, ছোনারী জানান,
এখন পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য তাদের আর ডাকা হয় না। আশেপাশের অন্য সম্প্রদায়ের
লোকজনও তাদের ঘৃণার চোখে দেখে। অসুখ বিসুখে তাই কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় না।
রবিদাসদের শিশুরা বেশীর ভাগই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। টেংগর পাড়া হরিজন পল্লীর
লক্ষী রানী, দুলারী, ঝর্ণা রবিদাস বলেন “আমাগোর এমনিতে দিন
চলে না। পেট চালানোর জন্য ছোটবেলা থেকেই তাদের কাজে পাঠাইতে হয়। তাই শিশুদের স্কুলে যাওয়া হয় না।”
ধন্ধাজ, মিলন, মঙ্গল রবিদাস বলেন, আমাদের জুতা
মেরামতের কাজের জন্য কোন নিজের জায়গা নেই। রাস্তার ধারে, অন্যের দোকানের সামনে বসে কাজ করতে হয়। অনেক সময় রাস্তা ও
দোকানের মালিক আমাদেরকে দোকানের সামনে থেকে উঠিয়ে দেয়। তারা আরও জানায়, এ পেশায় সারাদিন কাজ করে আয় হয় ৮০-১২০ টাকা যা দিয়ে দিন চলে না। তাই তারা এখন সেলুনসহ
অন্যান্য পেশায় কাজ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু নি¤œজাত বলে তাদের সেভাবে কেউ কাজও দেয় না। মুসলমানরা টুকটাক দিলেও বর্ণ প্রথার কারণে
উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা থাকে তাদের ধরা ছুয়ার বাইরে। একটা সময় এলাকায় পশু মারা গেলে তাদের ডাক
পরত। মৃত পশুর চামড়া ছাড়িয়ে
টুকটাক আয় হত। এখন এ ব্যবসায়ও অন্যরা ভাগ বসিয়েছে জানালেন হিন্দু পাড়ার ভন রবিদাস ও মুকলাল রবিদাস।
রবিদাসদের বিবাহ, আতœীয়তা, সালিশ-বিচার নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। হিন্দু সমাজের নিচুজাত
বলে তাদের বিবাহের কোন নথি বা রেজিষ্ট্রেশন হয় না। বাল্যবিবাহ, বহু বিবাহ, যৌতুক সমস্যা এদের নিত্য সঙ্গী। ফলে দারিদ্র্যের পাশাপাশি
নিচুজাতের দোহাই দিয়ে তাদের ছেলে মেয়েদের অনত্র বিবাহ দিতেও পারে না। এ ধরনের নানামুখী সমস্যার
বেড়াজালে আটকে শ্রীবরদীর মূচি সম্প্রদায় আজ অস্তিত্ব সংকটে। প্রাচীন ও প্রয়োজনীয় এ পেশাকে টিকিয়ে রাখতে
এদের সাহায্যে হাত বাড়ানোর সময় এখনই। তা না হলে এ সম্প্রদায়কে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন